ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

নতুন আয়কর আইনে সুবিধা দুর্নীতিবাজদেরই!

২০২৩ আগস্ট ২৪ ১৮:১১:৩২
নতুন আয়কর আইনে সুবিধা দুর্নীতিবাজদেরই!

নিজস্ব প্রতিবেদক : অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টদের আয়কর নথি, সম্পদের হিসাবসহ অভিযুক্তের সব তথ্য-উপাত্ত তলব করে যাচাই-বাছাই করার ক্ষমতা রয়েছে দুদকের। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনে বিষয়টি স্পষ্ট।

তবে চলতি বছর পাস হওয়া নতুন আয়কর আইন-২০২৩-এ অভিযুক্ত ব্যক্তির আয়কর রিটার্ন তলবের ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যার ফলে নতুন আয়কর আইনে দুর্নীতিবাজদেরই সুবিধা দেওয়া হল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুদকের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, নতুন আয়কর আইনের ফলে আমাদের অসুবিধায় পড়তে হবে। কেননা কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির আয়কর নথি চাইতে গেলে সেটা আর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পাওয়া যাবে না। নথি পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজকে দীর্ঘায়িত করবে। আইনটি দুর্নীতিবাজদের জন্য হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এবং টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, নতুন আয়কর আইনের ফলে দুর্নীতিবাজরা দায়মুক্তির সুযোগ পাবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর বিভাগের সদস্য (করনীতি) ড. সামস উদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘আগে আয়কর নথি দেওয়ার সুযোগ ছিল না। সেটায় গোপনীয়তার ব্যাপার ছিল। তখন দুদক এটি আন-অফিসিয়ালি নিত। এখন দুদক এই নথি অফিসিয়ালি নিতে পারবে। আমি দুদকের বিষয়গুলো বলতে পারছি না। আইনের ব্যাখ্যাও দিতে পারব না। এটা আদালত দিতে পারবেন। আমার এত ধারণা নাই। তবে একটা আইন যখন হয়, সেটা প্রয়োগ করতে গেলে সুবিধা-অসুবিধা বোঝা যায়।’

নতুন আইনে যা আছে

সংসদে পাস হওয়া আয়কর আইন-২০২৩-এর ৩০৯-এর (২) উপধারায় বলা আছে, ‘সাক্ষ্য আইন-১৯৭২, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ বা অন্য কোনো আইনে যাহা কিছু থাকুক না কেন সংশ্লিষ্ট রিটার্ন বা রেকর্ড প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী কর্তৃক উপস্থাপনের নির্দেশ প্রদান বা সাক্ষ্য প্রমাণ তলব করিতে পারিবে না।’

একই আইনের ৩০৯ ধারার ৩ (আ) উপধারায় উল্লেখ আছে, ‘তবে দণ্ডবিধি ১৮৬০ ও দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর অধীনে শর্ত থাকে যে, যেই ক্ষেত্রে তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনীয় কোনো কাগজাদি, বা কোনো বিবৃতি, রিটার্ন হিসাব, দলিলাদি, সাক্ষ্য, হলফনামা বা জমাকৃত বিষয়াদি প্রকাশ বা প্রদানের বিষয়ে আমলি আদালত আদেশ করিবে কেবল সেই ক্ষেত্রে উক্তরূপ প্রয়োজনীয় কোনো কাগজাদি, বা কোনো বিবৃতি, রিটার্ন হিসাব, দলিলাদি, সাক্ষ্য, হলফনামা বা জমাকৃত বিষয়াদি প্রকাশ বা প্রদান করা যাইবে।’

‘আইনটির ফলে দুর্নীতিবাজদের সুবিধা হবে’

দুদকে অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তার অভিমত হলো- নতুন এই আইনের ফলে দুর্নীতিবাজরা সুবিধা পাবে। কারণ দুদক অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে দোষী প্রমাণ হলেই কেবল মামলা করে থাকে। এ কারণে মামলা করার আগেই অভিযুক্ত বা সন্দেহযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নথি তলব করে থাকে।

কিন্তু নতুন আয়কর আইনে বলা হয়েছে, আমলি আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে তদন্তের জন্য আয়কর নথি দেওয়া হবে। এদিকে অনুসন্ধান পর্যায়েই দুদকের নথি প্রয়োজন পড়ে। তাই আদালতের অনুমতির প্রক্রিয়া এক্ষেত্রে অযৌক্তিক।

দুদকের আইনজীবী ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই আইনের ফলে দুদক কাজের স্বাভাবিক গতি হারাবে, সুবিধা পাবে দুর্নীতিবাজরা। ঠিক কী কারণে আইনটি প্রণয়ন ও পাস হয়েছে, এর ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করা দুদকের কাজ হলেও, সংসদে পাস হওয়া আয়কর আইন-২০২৩-এর কারণে স্বাধীন সংস্থাটির ক্ষমতা খর্ব হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে যেকোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিষয়ে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা চাহিদাপত্র দিয়ে অভিযুক্তদের আয়কর নথিসহ সব রেকর্ডপত্র সংগ্রহ ও জব্দ করতে পারত।

তবে সংসদে পাস হওয়া নতুন আয়কর আইন-২০২৩ পাস হওয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আয়কর নথি দুদককে দিতে বাধ্য থাকবে না রাজস্ব বোর্ড।

এ প্রসঙ্গে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘রাজস্ব বোর্ডের যারা এই আইন তৈরিতে কাজ করেছেন, তারা অদক্ষ। দুর্নীতির পক্ষে যায়Ñ এমন একটি আইন তারা কোনোভাবে করতে পারেন না।

দুদক আইনেই আছে সংস্থাটি যেকোনো সময় অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে আয়কর নথি তলব করতে পারবে। আপিল বিভাগে গেলেই এটার বিরুদ্ধে রায় হবে। সরকারের উচিত আইনটি বাতিল করা।’

পাস হওয়া আইনটির বিষয়ে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘অনুসন্ধান করতে গিয়ে কর্মকর্তারা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, এমন অভিযোগ পাইনি। যদি অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন তখন আমরা এটা কমিশনের নজরে আনব। যদি এমন হয় তবে অবশ্যই কমিশন দুদক আইনে যা আছে সেটা অনুসরণ করবে।’

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন) মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, ১৯৮৪ সালে আয়কর অধ্যাদেশকেই নানা রকম শর্তজুড়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের দুর্নীতিবিরোধী যে জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে এই আইন তারও বিরোধী। দুদক দুর্নীতি নির্মূলে কাজ করে, এই সংস্থাটির কাজে বাধা দেওয়ার মানে দুর্নীতিকে আড়াল করার একটা প্রচেষ্টা রয়েছে আইনটিতে।

কমিশনের এই সাবেক মহাপরিচালক বলেন, নতুন আয়কর আইনটি আপিল বিভাগের একটি রায়ের অবমাননা। আপিল বিভাগের রায়ে বলা আছে, দুদক নিজস্ব আইনের বলে যেকোনো কাগজপত্র অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য তলব করতে পারে। কিন্তু এই আইনে সেটি ভঙ্গ করা হয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আইনটি পাস হওয়ার পরই সমালোচনা করেন। সে সময় তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের যে জিরো টলারেন্সের প্রতিশ্রুতি, সেটি সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কী করে ক্ষুণ্ন করা হয়, তার আরেকটি বড় প্রমাণ আয়কর আইন-২০২৩।

আইনটি পাস হওয়ার ফলে দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তির সুযোগ আরও জোরদার করা হয়েছে। যারা কমিশনকে অকার্যকর দেখতে চায় তারাই আইনটির সুবিধা নেবে বলে তিনি মনে করেন।

শেয়ারনিউজ, ২৪ আগস্ট ২০২৩

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে