ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

প্রিমিয়ার সিমেন্টের বিরুদ্ধে সাড়ে ৫৫ কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগ

২০২৩ অক্টোবর ১১ ০৭:০৩:৫৫
প্রিমিয়ার সিমেন্টের বিরুদ্ধে সাড়ে ৫৫ কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক : শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট খাতের কোম্পানি প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেড কর ফাঁকি দিতে অনিয়ম করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানিটি এক করবর্ষে রিজার্ভ অ্যান্ড সারপ্লাস এবং রিটেইন আর্নিংস হিসেবে হস্তান্তর করতে পারবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা। কিন্তু হস্তান্তর করেছে প্রায় ৩২৩ কোটি টাকা। বিধিবহির্ভূতভাবে হস্তান্তর করা এই টাকার ওপর প্রায় ৩২ কোটি টাকার আয়কর পরিশোধ করা হয়নি।

অন্যদিকে, বিদেশ থেকে যে মূল্যের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানি করেছে, বার্ষিক প্রতিবেদনে (অডিট রিপোর্ট) তার মূল্য কম দেখানো হয়েছে। দুই করবর্ষে কাঁচামাল ও মেশিনারিজের মূল্য কম দেখানো হয়েছে প্রায় ১৫৬ কোটি টাকা। কর না দিতেই মূল্য কম দেখানো হয়েছে। তবে অনিয়ম করেও আয়কর বিভাগের নজর এড়াতে পারেনি কোম্পানিটি। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ করবর্ষের আয়কর নথি ও বার্ষিক প্রতিবেদন যাচাই করে এই অনিয়ম উদ্ঘাটন করেছে কর পরিদর্শন পরিদপ্তর, ঢাকা। অনিয়ম করা খাতে কর আদায়ের ব্যবস্থা নিতে এনবিআর ও সংশ্লিষ্ট কর সার্কেলকে এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।

সূত্রমতে, কর পরিদর্শন পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রাম-এর সার্কেল-৭ (কোম্পানিজ) পরিদর্শন প্রতিবেদন দেয়ার উদ্যোগ নেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই সার্কেলের পাঁচটি কোম্পানি ও একজন করদাতার ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ করবর্ষের আয়কর নথি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দিয়েছেন, যাতে প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের আয়কর নথি যাচাই করে আয়কর সংক্রান্ত এসব অনিয়ম পেয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেড শেয়ারবাজার তালিকাভুক্ত কোম্পানি। এই করদাতা কোম্পানির ২০২১-২২ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে। রিটার্নে ইক্যুইটি খাতে ‘রিজার্ভ অ্যান্ড সারপ্লাস’ এবং ‘রিটেইন আর্নিংস’-এ (৬৯৫,৬৪,৮০,৯৯২-৩৭২,২৪,৫৭,৫৬৩) বা ৩২৩ কোটি ৪০ লাখ ২৩ হাজার ৪২৯ টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে। করদাতা কোম্পানির পূর্ববর্তী করবর্ষের কর পরিশোধিত নিট আয় দেখানো হয়েছে ২৭ কোটি ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আয়কর আইন, ২০২৩-এর ২২ ধারা অনুযায়ী, করদাতা কোম্পানি ১৮ কোটি ৯৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা রিজার্ভ অ্যান্ড সারপ্লাস এবং রিটেইন আনিংস হিসেবে হস্তান্তর করতে পারবে।

২২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সংরক্ষিত আয় (রিটেইন আর্নিংস, সঞ্চিতি বা রিজার্ভ), উদ্বৃত্ত (সারপ্লাস) ইত্যাদির ওপর করারোপÑএই আইন বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, যদি কোনো করবর্ষে কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর (১৮নং আইন) অধীনে নিবন্ধিত এবং বাংলাদেশ স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি কর্তৃক সংরক্ষিত আয়ে অথবা কোনো তহবিল, সঞ্চিতি বা উদ্বৃত্ত যে নামেই অভিহিত হউক না কেন, পূর্ববর্তী করবর্ষের কর পরিশোধিত নিট আয় থেকে অর্থ স্থানান্তর করিয়া থাকে এবং এই স্থানান্তরিত অর্থের পরিমাণ পূর্ববর্তী করবর্ষে কোম্পানি কর্তৃক যে-ই পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরিত হয়েছে, তার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর প্রদেয় হবে।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস কোম্পানি আয়কর আইনবহির্ভূতভাবে ৩২৩ কোটি ৪০ লাখ ২৩ হাজার ৪২৯ টাকা রিজার্ভ অ্যান্ড সারপ্লাস এবং রিটেইন আর্নিংস হিসেবে হস্তান্তর করেছে। আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী, ২০২১-২২ করবর্ষে আইনবহির্ভূতভাবে হস্তান্তর করা এই টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে ৩২ কোটি ৩৪ লাখ দুই হাজার ৩৪২ টাকা কর আদায় করতে হবে, যা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করেনি।

রিজার্ভ অ্যান্ড সারপ্লাস এবং রিটেইন আর্নিংস হিসেবে ৩২৩ কোটি ৪০ লাখ ২৩ হাজার ৪২৯ টাকা হস্তান্তরের বিষয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘একটা ফিন্যান্সিয়াল ইয়ারে প্রিমিয়ার সিমেন্টের এত টাকা প্রফিট হয়নি। হস্তান্তর করার সুযোগ নেই। আমাদের ইপিএস, প্রফিট দেখলে সহজে বলতে পারবেন। আমাদের ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট চেক করলে দেখতে পাবেন। এরপরও আমরা যাচাই করে দেখছি। কর বিভাগ তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছে। প্রতিটা আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। আমাদের কাছে এখনও কোনো চিঠি আসেনি। এলে ব্যবস্থা নেব।’

অপরদিকে প্রিমিয়ার সিমেন্টে ২০২১-২২ করবর্ষের রিটার্নে আমদানি করা কাঁচামাল ও মেশিনারিজ খাতের যে ব্যয় বা মূল্য দেখিয়েছে, সেখানেও অনিয়ম পেয়েছে পরিদর্শন পরিদপ্তর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদন বা অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১-২২ করবর্ষে মোট ৯০৩ কোটি ৪৩ লাখ ২১ হাজার ৮২৩ টাকার কাঁচামাল আমদানি দেখানো হয়েছে।

এছাড়া স্থায়ী সম্পদ সংযোজনে প্ল্যান্ট অ্যান্ড মেশিনারিজ খাতে আমদানি করা ক্যাপিটাল মেশিনারিজের মূল্য দেখানো হয়েছে ৬১ লাখ দুই হাজার ৩৯ টাকা, মোটর ভেহিক্যাল আমদানি চার কোটি ৮২ লাখ ৩৭ হাজার ৩৩৯ টাকা, এয়ার কম্প্রেশনার দুই কোটি ১০ লাখ ১২ হাজার ১৪৬ টাকা ও গ্রাউন্ডিং মিডিয়া দুই কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯৭ টাকা। কাঁচামাল ও মেশিনারিজের মোট মূল্য দেখানো হয়েছে (৯০৩,৪৩,২১,৮২৩ + ৬১,০২,০৩৯ + ৪,৮২,৩৭,৩৩৯ + ২,১০,১২,১৪৬ + ২,৫০,৪৪,৪৯) বা ৯১৩ কোটি ৪৭ লাখ ১৭ হাজার ৮৪৪ টাকা। পরিদর্শন পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা এনবিআরের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থেকে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ২০২১-২২ করবর্ষের আমদানির তথ্য যাচাই করেছে।

এতে দেখা গেছে, ২০২১-২২ করবর্ষে কোম্পানির আমদানি করা কাঁচামাল ও মেশিনারিজের মোট মূল্য ৯৬০ কোটি ৫৮ লাখ ৬৫ হাজার ৫৮৯ টাকা। সে হিসেবে করদাতা কোম্পানি ওই করবর্ষে কাঁচামাল ও মেশিনারিজের মূল্য কম দেখিয়েছে (৯৬০,৫৮,৬৫,৫৮৯- ৯১৩,৪৭,১৭,৮৪৪) ৪৭ কোটি ১১ লাখ ৪৭ হাজার ৭৪৫ টাকা। প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিতে কম মূল্য দেখিয়েছে। আয়কর আইনের ২০ ধারা অনুযায়ী ৪৭ কোটি ১১ লাখ ৪৭ হাজার ৭৪৫ টাকার ওপর ৫০ শতাংশ হারে ২৩ কোটি ৫৫ লাখ ৭৩ লাখ ৮৭২ টাকা কর প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রিমিয়ার সিমেন্ট ২০২০-২১ করবর্ষেও ২০২১-২২ করবর্ষের মতো একইভাবে কাঁচামাল ও মেশিনারিজের মূল্য কম দেখিয়ে অনিয়ম করেছে। রিটার্নের সঙ্গে দাখিল করা কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ করবর্ষে মোট কাঁচামাল আমদানি দেখানো হয়েছে ৭৩০ কোটি ৮৭ লাখ ৪৫ হাজার ৭১ টাকা।

এছাড়া প্লান্ট মেশিনারিজ খাতে আমদানি করা ক্যাপিটাল মেশিনারিজের মূল্য এক কোটি ৫৭ লাখ ২৮ হাজার ২৭ টাকা এবং মোটর ভেহিক্যাল ১৪ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা দেখানো হয়েছে। ওই করবর্ষে আমদানি কাঁচামাল ও মেশিনারিজের মোট মূল্য দেখানো হয়েছে মোট (৭৩০,৮৭,৪৫,০৭১ + ১,৫৭,২৮,০২৭ + ১৪,৬৯,৫০০) ৭৩২ কোটি ৫৯ লাখ ৪২ হাজার ৫৯৮ টাকা। কর কর্মকর্তারা এনবিআরের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড থেকে ২০২০-২১ করবর্ষের প্রতিষ্ঠানের আমদানির তথ্য যাচাই করেছে, যাতে দেখা গেছে, কোম্পানি ওই করবর্ষে মোট ৮৪১ কোটি ৮১ লাখ ৬০ হাজার ৬৯০ টাকার কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানি করেছে। সে হিসেবে ওই করবর্ষে কোম্পানি কাঁচামাল ও মেশিনারিজ খাতে কম দেখিয়েছে (৮৪১,৮১,৬০,৬৯০- ৭৩২,৫৯,৪২,৫৯৮) বা ১০৯ কোটি ২২ লাখ ১৮ হাজার ৯২ টাকা। আইনের ২০ ধারা অনুযায়ী এই টাকার উপর ৫০ শতাংশ হারে প্রযোজ্য কর ৫৪ কোটি ৬১ লাখ ৯ হাজার ৪৬ টাকা। এসব অনিয়ম করায় ২১৩ ধারা অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করতে কর সার্কেলকে প্রতিবেদনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কাঁচামাল আমদানি ও মেশিনারিজের মূল্য পার্থক্য বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমদানির ক্ষেত্রে তিনটা ক্ষেত্রে কাজ হয়। বিল অব এন্ট্রি দাখিল, অ্যাসেসমেন্ট ও রিলিজ। এমনটা হতে পারে যে, বিল অব এন্ট্রি ৩০ জুন অ্যাসাইকুডাতে রেকর্ড হয়ে গেল। বাকি কাজ জুলাইয়ে হয়েছে। এতে আমদানি দুটা ফিন্যান্সিয়াল ইয়ারে চলে গেছে। ’

তিনি বলেন, ‘যেটা জুনে হলো, মালটা আমার ফ্যাক্টরিতে যতক্ষণ পৌঁছাবে না ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এন্ট্রি দিতে পারব না। তারা যদি বলে, এই বিল অব এন্ট্রি খাতায় নেই। সেটা আমরা স্পেসিফিক জমা দিতে পারি। কিন্তু একটা ইয়ারের মধ্যে সব হিসাব করে বের করার কোনো কায়দা নেই। কারণ শত শত বিল অব এন্ট্রি, কয়টা চেক করবেন? এর জন্য হিসাবে গরমিল হতে পারে।’

সূত্রমতে, প্রতিবেদনে দুই করবর্ষের রিটার্ন যাচাই করে আরও কয়েকটি অনিয়ম পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রিমিয়ার সিমেন্ট কোম্পানি করদাতা ২০২১-২২ করবর্ষে প্রশাসনিক ও ফাইন্যান্সিয়াল খরচ হিসেবে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, সিমেন্ট টেস্ট, প্রশাসনিক ও ফাইন্যান্সিয়াল এবং বিক্রয় ও বিপণন খাতের স্টেশনারি, ট্রেডিং, পে-লোডার খাতে খরচ দাবি করা হয়েছে। এসব খাত উৎসে কর কর্তনযোগ্য হলে কর্তন করেনি।

এছাড়া ২০২০-২১ করবর্ষে কারখানার দালান খাতে বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ ইনস্টলেশন, অফিস ইক্যুইপমেন্ট, ভেসেল, পোর্টেবল সিমেন্ট সাইলো খাতে বিনিয়োগ প্রদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু সঠিকভাবে উৎসে কর কর্তন করা হয়নি। এছাড়া মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিক্রি ও বিপণন, সিমেন্ট টেস্ট, পে-লোডার, ফুয়েল অ্যান্ড লুব্রিক্যান্ট, স্টেশনারিসহ বেশ কিছু খাতে খরচ দাবি করা হলেও উৎসে কর কর্তন করা হয়নি। সঠিকভাবে উৎসে কর কর্তন করতে সার্কেলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

শেয়ারনিউজ, ১১ অক্টোবর ২০২৩

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে