ঢাকা, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫
Sharenews24

গুম তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে র‌্যাবের গোপন বন্দিশালার পর্দা ফাঁস

২০২৫ জুন ১০ ১৫:০৮:২৮
গুম তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে র‌্যাবের গোপন বন্দিশালার পর্দা ফাঁস

নিজস্ব প্রতিবেদক: ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে পরিচালিত দুটি গোপন বন্দিশালা—সাংকেতিক নাম ‘হাসপাতাল’ ও ‘ক্লিনিক’—এর বিস্তারিত তথ্য গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এই বন্দিশালাগুলো পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিল র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা। ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।

গোপন বন্দিশালার অবস্থান ও প্রকৃতি

'হাসপাতাল': উত্তরার র‌্যাব-১ কার্যালয়ের চত্বরে অবস্থিত টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল হিসেবে পরিচিত এই বন্দিশালাটি র‌্যাব সদর দপ্তরের অধীনে, তবে সুনির্দিষ্টভাবে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা দ্বারা পরিচালিত হতো। এটি তিনটি আলাদা অংশে বিভক্ত ছিল: প্রশাসনিক এলাকা, একটি বৃহত্তর বন্দিশালা এবং একটি নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদের ছোট এলাকা।

'ক্লিনিক' (গ্লাস হাউস): র‌্যাব সদর দপ্তরের চত্বরেই কাচঘেরা কাঠামো নিয়ে পরিচালিত হতো এই বন্দিশালাটি, যা 'গ্লাস হাউস' নামেও পরিচিত ছিল। এর তৃতীয় তলায় একসময় ছয়টি ছোট বন্দিশালা ছিল।

গুমের আলামত ধ্বংস ও ব্যারিস্টার আরমানের সাক্ষ্য

অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৭ আগস্ট গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে, যা ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করছে। প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গত ১৫ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

দ্বিতীয় প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কীভাবে গুমের আলামতগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। ডিজিএফআই পরিচালিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি) সহ বিভিন্ন সংস্থায় ৫ আগস্টের পর গুমের আলামত ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে। 'হাসপাতাল' ও 'ক্লিনিক' নামে র‌্যাব পরিচালিত দুটি গোপন বন্দিশালার অনেক আলামতও সরকার পতনের পর ধ্বংস করা হয়, যা অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই করেছে।

গোপন বন্দিশালা 'হাসপাতাল'-এর খোঁজ পাওয়া যায় মূলত ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমের (আরমান) বর্ণনা অনুযায়ী। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট মিরপুর ডিওএইচএস থেকে তাকে গুম করা হয়েছিল এবং গত ৬ আগস্ট তিনি পরিবারের কাছে ফেরেন। তার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, টিএফআই সেলের নির্যাতন এলাকা এবং পরে একটি গোপন কক্ষের অস্তিত্ব নিশ্চিত হওয়া যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে তাকে ডিজিএফআইয়ের 'আয়নাঘরে' আটক রাখার কথা শোনা গেলেও, তার বর্ণনার সঙ্গে ডিজিএফআইয়ের বন্দিশালার বৈশিষ্ট্যগুলোর অসামঞ্জস্যতা ছিল। পরে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে ওই গোপন কক্ষের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়।

প্রমাণ ধ্বংস, হুমকি ও তদন্তে বাধা

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, টিএফআই সেলের গোপন কক্ষ আবিষ্কারের পর কমিশন নিশ্চিত হয় যে, ২০২৪ সালের আগস্টে হাসিনার দেশত্যাগের পরপরই এই স্থানে প্রমাণ ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে তা চলমান ছিল। র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন পদে দায়িত্ব পরিবর্তনের পরও আলামত ধ্বংস বন্ধ হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিশনের সদস্যদের সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাও ঘটেছে। ব্যক্তিগতভাবে, মুঠোফোনের মাধ্যমে এবং অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে এসব হুমকি দেওয়া হয়। কমিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট বা চরমপন্থী হিসেবে অপপ্রচারও চালানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ কর্মকর্তাই অভিন্ন ভাষায় দায় অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন যে তারা উক্ত ভবনটির অস্তিত্ব জানতেন না বা সেখানে বন্দীর উপস্থিতির বিষয়ে কিছু জানেন না। তবে কমিশনের কাছে প্রামাণ্য উপকরণ রয়েছে যা নির্দেশ করে র‌্যাবের মহাপরিচালক এবং অতিরিক্ত মহাপাপরিচালক স্তরেও টিএফআই সেলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল।

বিচার সম্ভব: কমিশনের আশাবাদ

কমিশন জানিয়েছে, অনুসন্ধানে তারা নিশ্চিত হয়েছে যে গুমের পুরো সময়ে র‌্যাব একটি সুসংহত ও কেন্দ্রীভূত নির্দেশনা কাঠামো বজায় রেখেছে, যেখানে ক্ষুদ্রতম সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যও উচ্চপর্যায়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো। এটি ইঙ্গিত করে যে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি ছিল।

তদন্ত কমিশন অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা এমন কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সাক্ষ্যও পেয়েছে, যারা গুমের ঘটনার সময়ে গোপন বন্দিশালা টিএফআই সেলে কর্মরত ছিলেন এবং বিভিন্ন ব্যক্তির আটক থাকার কথা স্বীকার করেছেন। কমিশন যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠা করেছে যে টিএফআই সেল বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল—এই দাবি স্পষ্টতই অসত্য। সুতরাং, উক্ত ভবনে সংঘটিত দীর্ঘমেয়াদী গুম এবং পদ্ধতিগত অমানবিক নির্যাতনের জন্য এসব কর্মকর্তারা দায়ী।

কমিশন মনে করে, ব্যারিস্টার আরমানের মতো মামলায় দায় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দায়মুক্তির সংস্কৃতিতে আঘাত হানা সম্ভব। কমিশন বলছে, এই ঘটনা প্রমাণ করে, বিচার সম্ভব এবং ক্ষমতাবানেরাও বিচারের আওতার বাইরে নন।

মারুফ/

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে