ঢাকা, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
Sharenews24

‘আমার পায়ের কাছে আসবে একদিন তারা’

২০২৫ এপ্রিল ৩০ ০৮:২২:৫৯
‘আমার পায়ের কাছে আসবে একদিন তারা’

নিজস্ব প্রতিবেদক: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদকন্যা লা‌মিয়া আক্তা‌রের হা‌তে লেখা এক‌টি ডা‌য়েরির সন্ধান পাওয়া গে‌ছে। সেখা‌নে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ জ‌সিম উদ্দি‌নের ছ‌বি এঁকেছেন লা‌মিয়া। সেই ছ‌বির পা‌শে বক্স আঁক‌লেও তা‌তে কা‌রো ছ‌বি ছিল না। পাশাপা‌শি বাবার মৃত‌্যুর পর স্বজন‌দের কাছ থে‌কে অব‌হেলা বিষয় উল্লেখ ক‌রে‌ছেন।

বাবার অবর্তমা‌নে প‌রিবা‌রের পা‌শে দাঁড়া‌নোর প্রতিজ্ঞাও ক‌রে‌ছি‌লেন।সেই শাহসী শহীদকন‌্যা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর আত্মহত‌্যার পথ বেঁচে নি‌লেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গতবছর ১৯ জুলাই আদাবরে গুলিবিদ্ধ হন তার বাবা। ১০ দিন পর জ‌সিম উদ্দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।পটুয়াখালীর দুমকিতে শহিদ জসিমকে সমাহিত করা হয়। আর সেখানেই গত ১৮ মার্চ বাবার কবর জিয়ারত করে ফেরার সময় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন মেয়েটি।

মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) রা‌তে সাংবা‌দিকরা লা‌মিয়ার নানাবা‌ড়ি আলগী গ্রা‌মে যান। লা‌মিয়ার পড়ার টে‌বি‌লে থাকা বই খাতার মধ‌্য থে‌কে ডা‌য়েরি‌টি উদ্ধার ক‌রেন।

লা‌মিয়ার নানি সে‌টি সাংবা‌দিক‌দের দেখান। লামিয়ার বাবা-মা ঢাকায় থাকতেন। বাবার মৃত্যুর পর মা তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। তার স‌ঙ্গে লা‌মিয়ার এক ভাই আর এক বোন থাক‌তেন। পাঙ্গা‌শিয়া ইউনিয়‌নের নলদোয়ানী গ্রামের বাড়িতে লামিয়ার দাদা-দাদি বসবাস করতেন।

দাদা দিনমজুর। লামিয়া থাকতেন তার নানাবাড়ি এই ইউয়িনের পাশাপাশি আলগী গ্রামে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার আসামিরা সবাই আলগী গ্রামের বাসিন্দা। তাদের সঙ্গে লামিয়ার পরিচয় ছিল।

লা‌মিয়ার নানার আধাপাকা ঘর। সাম‌নে বারান্দা। বারান্দা পে‌রি‌য়ে মূল ঘর। ঘ‌রের বাম দি‌কের এক কো‌নে পড়ার টে‌বিল। সেখা‌নে ছ‌ড়ি‌য়ে ছি‌টি‌য়ে প‌ড়ে আছে পাঠ‌্য বই। আছে ধর্মীয় বই। সেই বইয়ের ম‌ধ্যে ছিল লা‌মিয়ার হা‌তে লেখা এক‌টি ডা‌য়েরি। তার বাবার মৃত্যুর ২৬ ‌দিন পর সেই ডা‌য়েরির এক‌টি পাতায় তি‌নি লি‌খে‌ছি‌লেন। তারপর আরো এক‌টি পাতায় ভ‌বিষ্যতের কথা লি‌খে‌ছি‌লেন। বাবার ছ‌বিও এঁকে‌ছি‌লেন। তারপর এক‌টি ছ‌বি আঁকার জন‌্য শুধু রেখা টে‌নে‌ছি‌লেন। সে‌টি আর শেষ ক‌রে যে‌তে পা‌রেন‌নি।

ডা‌য়েরি‌তে যা লি‌খে‌ছেন তা আং‌শিক সং‌শোধন ক‌রে পাঠ‌কের জন‌্য উপস্থাপন করা হলো।

আমার জীব‌নের স্বপ্ন। আমার জীব‌নের ছোট এক‌টি স্বপ্ন, সে‌টি হলো, নি‌জে‌কে প্রতি‌ষ্ঠিত করা। বাবা মারা গে‌ছেন আজ ২৬ ‌দিন হলো। তার ভেত‌রেই দেখা যা‌চ্ছে, কে কত দূর ভা‌লোবা‌সে। বাবা যত‌দিন ছিল, তত‌দিন সবার কাছ থে‌কে আদর পাইছি। তাও খুব কম। আমার বাবায় মানুষ‌কে খাওয়া‌তে পার‌তো, তখন আমা‌দের প্রতি তারা (স্বজন) ভা‌লোবাসা দেখাইতো। আর এখন আমরা অসহায় হয়ে পড়‌ছি, দেইখা তারা আমা‌দের প্রতি অব‌হেলা ক‌রে। তাই আমি চাই নি‌জে‌কে এমন ক‌রে প্রতি‌ষ্ঠিত কর‌তে, যারা আজ অবহেলা ক‌রে তারা প্রতি‌ষ্ঠিত হবার পর আমার পা‌য়ের কা‌ছে ...

প‌রের পাতায় লি‌খে‌ছেন, আমা‌দের ভা‌লোবাসা নি‌য়ে আমা‌দের কা‌ছে অনুতাপ প্রকাশ ক‌রে। নি‌জের জীব‌নের ল‌ক্ষে শুধু প‌রিবার‌কে নি‌য়ে ভাই-বোন‌কে প্রতি‌ষ্ঠিত করা। তা‌দের সম্পন্ন লেখাপড়া শেষ করা‌নো। ভাইয়ের ভ‌বিষ‌্যৎ গড়া। ভাইকে মানু‌ষের ম‌তো মানুষ হি‌সে‌বে গ‌ড়ে তোলা। আব্বুর স্বপ্ন পূরন করা। যে‌দিন এইগু‌লো সব পূরণ কর‌তে পার‌ব, সে‌দিন আমার জীবন ভা‌লো কাট‌বে। আম্মু দোয়া কইরো এইগু‌লো সব পূরণ কর‌তে পা‌রি। নি‌জে মানু‌ষের ম‌তো মানুষ হইতে পা‌রি। আম্মু‌রে যেন সুখ দি‌তে পা‌রি। আম্মুর সব দুঃখ যেন মুছ‌তে পা‌রি। প‌রিবার‌কে নিয়া সু‌খে থাক‌তে পা‌রি। সে‌দিন সবাই আমা‌দের ...

মঙ্গলবার রা‌তে পটুয়াখাল‌ী মে‌ডি‌ক্যাল ক‌লেজ হাসপাতা‌লে গি‌য়ে দেখা গেছে, লা‌মিয়ার মা তার দুই ভাই-বোন‌কে নি‌য়ে ১৪ নম্বর কে‌বি‌নে শু‌য়ে প‌ড়ে‌ছেন। রু‌মের সাম‌নে এক নারী নি‌জে‌কে লা‌মিয়ার খালা ব‌লে প‌রিচয় দি‌য়ে‌ছেন।

জানা‌ গে‌ছে, স্বামী এবং মেয়েকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ রুমা বেগম (৩৫)। একই অবস্থা লামিয়ার ছোট বোন বুশরা আক্তারের (১৪)। লামিয়া মারা যাওয়ার পর থেকে কাঁদতে কাঁদতে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছোট ভাইটি কিছু বু‌ঝে উঠ‌তে নাপার‌লও মা‌য়ের স‌ঙ্গে কেঁদে‌ছেন। সে এখন অসুস্থ।

রবিবার (২৭ এপ্রিল) রাতে লামিয়াকে দুমকি উপজেলার পাঙ্গাশিয়া গ্রামের নিজ বাড়িতে দাফনের পর তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদেরকে স্বজনরা পটুয়াখালী সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। স্বজনরা এ দুজনকে নিয়েও শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

দুমকি সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল লা‌মিয়া আক্তার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এই শহীদকন্যা বা‌দি হ‌য়ে দুই আসামির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে দুমকি থানায় মামলা করেন।

লামিয়ার সহপাঠী সিফাত মুন্সি এবং পাঙ্গা‌শিয়া ইউনিয়‌নের মেহেরুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শাকিব মুন্সিকে মামলায় আসামি করা হয়। পুলিশ মামলা দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে।

সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামি আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে নিজেদের দোষ স্বীকার করেছেন।

সেই জবানবন্দিতে লামিয়ার আরেক সহপাঠীর নাম এসেছে। সেই সহপাঠীর নাম ইমরান মুন্সি। সে পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের আলগী গ্রামের মালেক মুন্সির ছেলে। মামলার এজাহারের কোথায় ইমরানের নাম ছিল না। এমনকি তাকে স্বাক্ষীও করা হয়নি।

আদালতে দুই আসামির অপরাধ স্বীকারের বিষয়টি জানতেন না লামিয়া। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি মামলার এসব কোনো অগ্রগতিই জেনে যেতে পারলেন না। তার আগেই শনিবার (২৬ এপ্রিল) রাতে ঢাকার একটি বাসায় ‘আত্মহত্যা’ করেন তিনি। পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের নিজ বাড়িতে তারা বাবা শহিদ জসিমের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়েছে।

মুয়াজ/

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে