ঢাকা, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কোম্পানি

প্রভাবশালীদের প্লেসমেন্ট সুবিধা দিয়ে শেয়ারবাজারে আসছে বেস্ট হোল্ডিংস

২০২৩ অক্টোবর ১৫ ১৮:০৫:২৯
প্রভাবশালীদের প্লেসমেন্ট সুবিধা দিয়ে শেয়ারবাজারে আসছে বেস্ট হোল্ডিংস

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ দুর্নীতির অভিযোগে মাত্র এক সপ্তাহ আগে ০৩ অক্টোবর বেস্ট হোল্ডিংসের (হোটেল লা মেরিডিয়ান) চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আমিন আহমেদ ভুইয়ার বিদেশে অর্থ পাচারসংক্রান্ত আরও একটি ঘটনার তদন্ত করছে দুদক।সেই কোম্পানিকেই বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজার থেকে ৩৫০ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

জানা গেছে, কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনতে বিদ্যমান আইনেও বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন নিয়েও জালিয়াতির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। কমিশনের সঙ্গে সমঝোতা এবং প্রভাবশালীদের প্লেসমেন্ট শেয়ার দিয়ে এই সুযোগ মিলেছে। এ ধরনের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্টরা। তবে বিএসইসি বলছে, আইনের মধ্যে থেকেই তারা অনুমোদন দিয়েছেন। এখানে আইনের কোনো লঙ্ঘন হয়নি।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, এই কোম্পানির অনুমোদনের ক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। কারণ কোম্পানিটি পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫ অনুসারে আবেদন করেছে। তারা ওই রুলসের শর্ত পূরণ করেছে। বাইরের অন্য কিছু রুলসে সংযুক্ত নেই।

গত মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) বিএসইসির কমিশন মিটিংয়ে এই কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদন অনুসারে বাজার থেকে কোম্পানিটি ৩৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করবে। এ ক্ষেত্রে প্রতি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা। কিন্তু এর প্রিমিয়াম কত হবে, তা বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে নির্ধারিত হবে।

২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন করে কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের সম্পদমূল্য দেখানো হয়েছে ৫৬ টাকা ৩৪ পয়সা। তবে পুনর্মূল্যায়নের আগে সম্পদ ছিল ৩২ টাকা ২৬ পয়সা। আলোচ্য সময় পর্যন্ত কোম্পানির প্রতি শেয়ারের বিপরীতে আয় (ইপিএস) ১ টাকা ২৪ পয়সা। আর ৫ বছরের গড় আয়৯৫ পয়সা।

এদিকে আইন লঙ্ঘন করে ২০২০ সালে কোম্পানিটি সরাসরি তালিকাভুক্তির আওতায় শেয়ারবাজারে আসার চেষ্টা করে। প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করে। ব্যাংকগুলো প্রাইভেট প্লেসমেন্টে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার ৬৫ টাকায় কেনে। ওই রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের শেয়ারের কারণে সরকারি কোম্পানি হিসাবে নাম দিয়ে সরাসরি তালিকাভুক্তির চেষ্টা করে। কিন্তু ওই সময়ে সরাসরি তালিকাভুক্তির উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

নিয়ম অনুসারে কোনো কোম্পানি আইপিওতে আবেদনের দুই বছর আগে থেকে শুধু স্টক শেয়ার ইস্যু ছাড়া অন্য কোনোভাবে মূলধন সংগ্রহ করতে পারে না। কিন্তু কোম্পানিটি এরকম সময়ের মধ্যে বন্ড ছেড়ে বড় অঙ্কের মূলধন বাড়িয়েছে। আবার বন্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে শেয়ারেও রূপান্তর করেছে। এটি আইনের পরিপন্থি।

তাই আইনের বাধ্যবাধকতায় কোম্পানিকে বিশেষ ছাড় দিয়ে গত ২৭ জুলাই গেজেট জারি করে বিএসইসি। ওই সময়েই কোম্পানিটির প্রতি বিএসইসির সুনজরের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এছাড়াও কমিশনের ভেতরে কর্মকর্তাদের একটি অংশ এই আইনি ছাড়ের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা তা আমলেই নেননি।

দুদকের তথ্য অনুসারে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বাজারের ৩০ দশমিক ২৫ কাঠা জমি ক্রয় দেখিয়ে ৯৫ কোটি টাকার তথ্য গোপন করে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু এবং বেস্ট হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান আমিন আহমেদ। এ ক্ষেত্রে সরকারের সাড়ে ৮ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে উল্লিখিত দুজনসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলার বাদী দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নুরুল হুদা। মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়, ২০১২ সালের ৮ জুলাই ক্যান্টনমেন্ট বাজার এলাকার ৬ নম্বর প্লটের ৩০.২৫ কাঠা জমি ১১০ কোটি টাকায় ক্রয় করে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু। ওই জমির বিক্রেতা আমিন আহমেদ।

কিন্তু নিবন্ধন মূল্য দেখানো হয় ১৫ কোটি ২৫ লাখ। অর্থাৎ ৯৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার তথ্য গোপন করা হয়। জমি বিক্রয় ও প্রকৃত মূল্য গোপন করতে আমিন আহমেদ তাকে সহযোগিতা করেছেন। আমিন আহমেদ ১৩৪টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও নগদে ৩১ কোটি ৫০ লাখ টাকা নিয়েছেন। এ ধরনের কাজ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায়। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

এদিকে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি বেস্ট হোল্ডিংসের ওই সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিন আহমেদ ভুইয়ার সম্পদ হিসাব চেয়েছে দুদক। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক কাজী শফিকুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে পরবর্তী ২১ কার্যদিবসের মধ্যে স্থাবর-অস্থাবর সব ধরনের সম্পদের হিসাব দিতে বলা হয়। তারা হিসাব জমা দেয়। তবে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে। এর আগে দুদকের উপ-পরিচালক মোশারফ হোসেন মৃধার স্বাক্ষরে পাঠানো চিঠিতে বলা হয় আমিন আহমেদ ভুইয়া হোটেল ব্যবসার আড়ালে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও হোটেল ব্যবসার আড়ালে বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। নোয়াখালীর সুবর্ণচর এলাকায় ৭০০ একর সরকারি খাসজমি জবরদখল করে রেখেছেন তিনি।

চিঠিতে আরও বলা হয়, দুদকে হাজির হওয়ার সময় নিজের পরিবারের পাসপোর্ট ও ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ফটোকপি, সম্পদ অর্জনসংক্রান্ত সব দলিল/রেকর্ডপত্র, আয়কর নথির যাবতীয় রেকর্ডপত্র জমা নেওয়া হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এই ঘটনাটি বর্তমানে থমকে আছে। তবে দুদক সূত্র বলছে, তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।

এদিকে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনেও ঝুঁকি রয়েছে বলে জানা গেছে। কারণ এর আগে বিতর্কিত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষিদ্ধ অডিট কোম্পানি নিয়ে আর্থিক রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল। কোম্পানির পুরো আর্থিক রিপোর্ট সত্য হলেও রয়েছে ঝুঁকি। কারণ কোম্পানি বর্তমানে যে টাকায় মুনাফা করছে তার পুরোটা বিনিয়োগকারীদের দিলেও সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে পারবে। এর মানে হলো ব্যাংক ৬৫ টাকা বিনিয়োগ করে বছরে মাত্র ১ টাকা পাবে।

বর্তমানে কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসাবে রয়েছেন আমিন আহমেদ ভুইয়া, ব্যবস্থাপনা হাসান আহমেদ এবং পরিচালক আফ্রা আনজুম। এছাড়াও মনোনীত পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন উম্মে কুলসুম কনা, তাসনুবা ইসলাম, মঞ্জুর আহমেদ ভুইয়া, মোহাম্মদ মুসলিম আলী, নিরাঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম এবং খান ইকবাল হোসেন।

শেয়ারনিউজ, ১৫ অক্টোবর ২০২৩

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে