ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

আমেরিকা : যমের দুয়ারে স্বপ্ন দেখা মানুষের ভিড়

২০২৪ জানুয়ারি ০৮ ১৮:৫২:৩৮
আমেরিকা : যমের দুয়ারে স্বপ্ন দেখা মানুষের ভিড়

শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায় : মার্কিন অভিবাসী কবি রিকার্ডো ব্লাঙ্কোর ‘আদার ল্যান্ড’ কবিতার একটি চরণ, ‘আমেরিকা, দ্য পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন’!

তবু মেক্সিকো, ভারত, চিন, এল সালভাদোর, হন্ডুরাস, ফিলিপিন্স বা গুয়াতেমালা থেকে হাড়হাভাতে মানুষ দলে দলে গুপ্তপথে আমেরিকায় যাবে। খাঁখাঁ বরফ পেরিয়ে, রুখাশুখা মরুভূমি উজিয়ে, শ্বাপদসংকুল অরণ্য ছাপিয়ে, পারহীন পারাবারে ভেসে, অতল খরস্রোতা নদী সাঁতরে গরিবগুর্বো মানুষ আমেরিকায় ঢুকবে। ঢুকতে গিয়ে অনেকেই মারা পড়বে।

অনেকেই ধরা পড়বে রাজপেয়াদার হাতে। ট্রাম্প, বাইডেনরা তাঁদের নাম দেবেন ‘গাধার দল’, ইংরেজিতে ‘ডাঙ্কি ফ্লাইট’! এই ‘ডাঙ্কি’ মানে হল ‘ইললিগ্যাল ইমিগ্রেশন’ বা অবৈধ অভিবাসন!

‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’র মালিক নরেন্দ্র দামোদর মোদি সম্ভবত জানতেন না যে, ওই ‘ডাঙ্কি’ শব্দটা হল তাঁর দেশেরই অঙ্গরাজ্য পঞ্জাবের একটি বহুচর্চিত প্রবচন! রাজকুমার হিরানির সিনেমাটা বেরোনোর পরে বোঝা গিয়েছে বটে যে, পঞ্জাব থেকে অ্যাত্তো ভারতীয় লুকিয়ে চুরিয়ে ‘আম্রিকা’-তে ঢোকে যে, ‘ডাঙ্কি’ শব্দটা যথেষ্ট অসম্মানের সঙ্গে ওয়েবস্টার ডিকশনারিতে জায়গা করে নিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ঠিক এখন আমেরিকাবাসী অভিবাসীদের পঁচিশ শতাংশই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। সেটাও গত এক বছরে প্রায় দেড় লাখ বেআইনি অনুপ্রবেশকারীকে আমেরিকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরে। অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে বেশিরভাগই মেক্সিকান হলেও, যুগ্মভাবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত ও চিন।

আর আমেরিকায় অবৈধ অভিবাসী ভারতীয়দের মধ্যে পঞ্জাবের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দেয় ‘অচ্ছে ইন্ডিয়া’ প্রাইভেট লিমিটেডের ‘সিইও’ মোদিজির আপনা মুলুক গুজরাট!

গাঁগঞ্জের অবুঝ আনপড় মানুষকে ডলারের লোভ দেখিয়ে, শহর বা আধাশহরের মানুষকে ভুল বুঝিয়ে, এমনকি কিছু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষকে দিবাস্বপ্ন দেখিয়ে ওই ‘ডাঙ্কি বিজনেস’ চালায় কিছু ভূতুড়ে এজেন্সি, ভুয়ো নামঠিকানায়। বেনামে এই কারবারে জড়িত থাকে রাজনীতি ও প্রশাসনের কিছু গুরুঠাকুরও।

হিরানির সেলুলয়েডে যেমন প্রত্যন্ত এক গ্রামে পোস্টার পড়ে, ‘আমেরিকা কানাডায় পড়তে যেতে চান? মাত্র তিন দিনে মিলবে সুযোগ। যোগাযোগ করুন এই নম্বরে…’! ব্যাস, আজীবনের কষ্টার্জিত ও সঞ্চিত অর্থ দক্ষিণা হিসেবে দিয়ে মানুষ সেই ফাঁদে পা দেয়! কারণ? শুধুই ডলার! ডলার ভারী বিষম বস্তু। ডলার থাকলে নির্ধনের ধন হয়, গৃহহীনের বাড়ি হয়, পথিকের গাড়ি হয়!

তাছাড়া ডলারের দেশে কত জেল্লা, কত জমক, কত ব্র্যান্ড, কত কেতা! ভিড় নেই, ঘাম নেই! পথ আছে, পথিক নেই! মাঠ আছে, মানুষ নেই! আর এখন তো এক ডলার মানেই ‘বিরাশি সিক্কা’!

ভারতের মতোই, অবৈধ অভিবাসনের ব্যবসায় এই দস্তুর চালু আছে সংশ্লিষ্ট সব দেশেই। ওই মানব পাচার এজেন্সিগুলির সঙ্গে কাস্টমারদের কনট্রাক্ট হল, ‘আমেরিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া’! কীভাবে, কোথা দিয়ে ঢোকানো হবে, সে ব্যাপারে এজেন্সির মতামতই চূড়ান্ত। কোনও প্রশ্ন করা যাবে না!

প্রশ্ন করা যাবে না যে, মার্কিন মুলুকে ঢুকতে গিয়ে মরে গেলে কী হবে? আমেরিকায় ঢোকার পরে আদৌ কোনও কাজ জুটবে কি না বা কোনও থাকার জায়গা পাওয়া যাবে কি না? আমেরিকায় ঢুকে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলে কী হবে? এসবের দায়িত্ব ‘হি’জ হি’জ হু’জ হু’জ’!

স্বপ্নের ডলারল্যান্ডে ঢোকার আগে কেউ টেরও পায় না যে, স্বঘোষিত ‘সুসভ্য’ আমেরিকায় হোমল্যান্ড সিকিউরিটি নামে একটা ‘অসভ্য’ বস্তু আছে, যারা পারে না হেন কাজ নেই। এবং তারা সবজান্তা!

গোপনে আমেরিকায় ঢুকে যাওয়া অভিবাসীরা সস্তা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে ভারতীয়দের মালিকানাধীন মুদিখানা, রেস্তোরাঁ, বস্ত্রবিপণি বা সাংসারিক সামগ্রীর খুচরো দোকানে! তাদের গাড়ি নেই, কাজেই তারা হয় হাঁটে। নয় বাসে ওঠে। তারা ভাড়াবাড়িতে থাকে।

আর এইসব উপসর্গের সঙ্গে গায়ের চামড়ার রং বাদামি হলেই হয়ে গেল! কুনজর পড়ল হোমল্যান্ড সিকিউরিটির। এমনকি সাদা আমেরিকানদের একটা বড় অংশেরই ধারণা, ‘পুওর অ্যান্ড ব্রাউন’ মানেই অবৈধ অভিবাসী! এবার বোঝো ঠ্যালা!

হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মা- কে জেলে পুরে, তার দুধের শিশুকে অনাথাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়, আর বাবাকে কয়েদ করে রাখে খুনের দায়ে জেলখাটা আসামিদের সঙ্গে। কিন্তু কোনও প্রশ্ন করা যাবে না। মামলা চলবে বছরের পর বছর।

উপরন্তু এই হোমল্যান্ড সিকিউরিটিই ট্রাম্প, বাইডেনদের বদবুদ্ধি দেয় যে, বেআইনি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে দেওয়াল তুলে দিতে হবে। এই ধ্বনির প্রতিধ্বনি করেছিলেন বলেই তো, বাইডেনের কাছে হেরে গেলেও প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ আমেরিকানের ভোট পেয়েছিলেন ট্রাম্প!

অবশ্য শুধু তিনি কেন, বাইডেন যখনই বুঝতে পেরেছেন যে, সামনের ভোটে নিজের গদি টলমল, সঙ্গে সঙ্গেই তিনিও এখন ওই দেওয়ালের পক্ষেই ঝুঁকে পড়েছেন!

অথচ এটা কেউ ভাবছেই না যে, কত জায়গায় দেওয়াল হবে! প্রধানত তিনটি কিঞ্চিৎ অরক্ষিত সীমানা দিয়ে আমেরিকায় মানব পাচার করা হয়। মেক্সিকানদের চালান করা হয় মেক্সিকোর মরুদেশ সিউদাদ জুয়ারেজ দিয়ে কিংবা রিও গ্র্যান্ডে (আমেরিকায় যার নাম রিও ব্রাভো) নদীপথে।

ভারতীয় এবং চৈনিকদের পাচার করা হয় কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের বরফবহুল ভ্যাঙ্কুভার দিয়ে। এল সালভাদোর, হন্ডুরাস, ফিলিপিন্স এবং গুয়াতেমালার লোকদের কলম্বিয়া ও পানামার ড্যারিয়েন গ্যাপ নামক ভয়াল জঙ্গল দিয়ে নিয়ে এসে ভাসিয়ে দেওয়া হয় ক্যারিবিয়ান সমুদ্রপথে।

দেশের এরকম তিনটি বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেওয়াল তোলা কি আদৌ সম্ভব? আর সম্ভব হলেও, দেওয়ালের মধ্যে ভূত তো থাকবেই! তারা ঘুষের বিনিময়ে রাতের অন্ধকারে মালবাহী ট্রাকে চাপিয়ে অবৈধ অভিবাসীদের চালান করে দেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

তবে তারও আগে বলতেই হবে যে, আমেরিকার এইসব সীমান্ত এলাকা প্রাকৃতিকভাবেই যমের দুয়ার! হোয়াইট হাউসের হিসেব অনুযায়ী, গত এক বছরে চোরাপথে আমেরিকায় ঢুকতে চাওয়া তিন হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কেউ মরেছে প্রবল ঠান্ডায় বরফচাপা পড়ে, কেউ মরুপথে তীব্র জলাভাবে, কেউ জোয়ারের জলোচ্ছ্বাসে নৌকাডুবিতে, কেউ জঙ্গলে পথ হারিয়ে খাদ্যাভাবে।

এর বাইরে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এবং ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর অস্বাভাবিক মৃত্যুর হিসেব জুড়ে দিলে, গত বছরে ওই অনুপ্রবেশকারীদের মৃতের সংখ্যা আরও দুই হাজার বেড়ে যাবে। এই মৃত্যুগুলি হয়েছে মার্কিন জেলখানায় বন্দি অবস্থায় বিনা চিকিৎসায়, কাঁটাতারের বেড়ায় লাগানো ধারালো ব্লেডের কোপে এবং মালবাহী ট্রাকের নিশ্ছিদ্র কনটেনারে দমবন্ধ হয়ে!

কীভাবে বন্ধ করা যাবে মানুষের এই মরণের পানে ছুটে চলা? যথেষ্ট মানবিকতার সঙ্গে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে আমেরিকাকে। কারণ, বৈধ বা অবৈধ পথে বিশ্বের সর্বাধিক অভিবাসন হয় আমেরিকাতেই। সদ্য প্রকাশিত ‘টুওয়ারডস এ পোয়েটিক মেমরি অফ বেঙ্গল পার্টিশন’ বইয়ের লেখক লগ্নজিতা মুখোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, উত্তরাধুনিক পৃথিবীতে কেন একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশে যেতে হলে মানুষকে ভিসা করতে হবে?

সবচেয়ে আগে এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে হবে মানবাধিকারের ঢাক পেটানো আমেরিকাকেই। নইলে, অদূরভবিষ্যতে, বিশ্বের মানবিক মানচিত্রে আমেরিকার নতুন নাম হবে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’!

(লেখক আমেরিকার ন্যাশভিলের বাসিন্দা। প্রবন্ধকার)

শেয়ারনিউজ, ০৮ জানুয়ারি ২০২৪

পাঠকের মতামত:

প্রবাস এর সর্বশেষ খবর

প্রবাস - এর সব খবর



রে