নিজস্ব প্রতিবেদক : শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) চলতি ২০২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) আয় কমার পাশাপাশি ব্যয় বেড়েছে। এতে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফায় ভাটা পড়েছে।

একদিকে কোম্পানিগুলোর ঋণের বিপরীতে সুদহার উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়া, অন্যদিকে খেলাপি ঋণ ও বিভিন্ন ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির চাপে ভবিষৎ সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

শেয়ারবাজারের শীর্ষ ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২ অর্থবছর ও চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, সমাপ্ত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে অধিকাংশ কোম্পানির আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধির হার বেশি ছিল। তা ছাড়া এই সময়ে কোম্পানিগুলোর খেলাপি ঋণের বোঝাও বেড়েছে।

আইডিএলসি ফাইন্যান্স

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে আইডিএলসি ফাইন্যান্সের মোট আয় হয়েছে ৬৬৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৪৯.১০ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কোম্পানিটির নিট মুনাফা ২১.৪৪ শতাংশ কমে হয়েছে ৭২ কোটি ২০ লাখ টাকা। যেখানে ২০২২ অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ১ হাজার ২৭০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছিল ৪৩.৮০ শতাংশ। অর্থ বছরটিতে কোম্পানিটির নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় সাড়ে ৯ শতাংশ কমে হয়েছিল ১৯১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

কোম্পানিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে তাদের ঋণের বিপরীতে সুদ আয় কমেছে। এ ছাড়া তাদের বিনিয়োগ আয় এবং কমিশন, এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ আয় কমার পাশাপাশি অন্যান্য পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। এসব কারণে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির মুনাফায় ভাটা পড়েছে।

লংকাবাংলা ফাইন্যান্স

সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২ অর্থবছরে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের মোট আয় হয়েছিল ৯৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৬১.৯০ শতাংশ। এই অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় কোম্পানির নিট মুনাফা ৪৯.৩৯ শতাংশ কমে হয়েছিল ৬৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির মোট আয় হয়েছিল ৪৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৬১.৪০ শতাংশ। এই সময় নিট মুনাফা ৪৩.৫৩ শতাংশ কমে হয়েছে ৩১ কোটি ২০ লাখ টাকা।

কোম্পানিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ দ্বারা সুদ হার বেধে দেয়ার করণে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে তাদের সুদ আয় কমেছে। এ ছাড়া আলোচ্য সময়ে তাদের সম্পদের গুণগত মান অবনতি হওয়ায় এ সময় সঞ্চিতি বাড়াতে হয়েছে। পাশাপাশি লেনদেন কম হওয়ায় আলোচ্য সময়ে তাদের কমিশন, এক্সচেঞ্জ এবং ব্রোকারেজ আয় কমেছে। এসব কারণে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির নিট মুনাফা কমেছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্স

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের মোট আয় হয়েছে ৭৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্য থেকে কোম্পানিটির সার্বিক ব্যয় হয়েছে ৭২.১০ শতাংশ। এই ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির কর পরবর্তী নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৯.৭৮ শতাংশ কমে হয়েছে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যেখানে ২০২২ পূর্ণ অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ১৯২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছিল ৪২.৩০ শতাংশ। অর্থ বছরটিতে কোম্পানিটির নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় ৫.৮৬ শতাংশ কমে হয়েছিল ৩০ কোটি ৫০ লাখ।

প্রথমার্ধে মুনাফা কমার কারণ হিসাবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, এই সময়ে তাদের ঋণের বিপরীতে নিট সুদ আয় কমেছে। এছাড়া শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থেকেও এই সময়ে আয় কমেছে। এ কারণে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির মুনাফা কমেছে।

ডিবিএইচ ফাইন্যানন্স

সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২ অর্থবছরে ডিবিএইচ ফাইন্যানন্সের মোট আয় হয়েছিল ৫১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ২৮.৬০ শতাংশ। এই অর্থবছরে কোম্পানির নিট মুনাফা ২.৫৯ শতাংশ কমে হয়েছিল ১০৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির মোট আয় হয়েছিল ২৯৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৩১.৫০ শতাংশ। এ সময়ে নিট মুনাফা ১২.০৪ শতাংশ কমে হয়েছে ৪৯ কোটি টাকা।

আইসিবি ইনভেস্টমেন্ট

৩০ জুন সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে আইসিবি ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের মোট আয় হয়েছিল ১ হাজার ৬৩৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ২১.২০ শতাংশ। এই অর্থবছরে কোম্পানির নিট মুনাফা ২৫.৪১ শতাংশ বেড়ে হয়েছিল ১৪৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তবে সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২-২৩ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) কোম্পানিটির মোট আয় হয়েছে ৮৩৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৪৯ শতাংশ। আর নিট মুনাফা ৬৯.৭০ শতাংশ কমে হয়েছে ৪৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। আলোচ্য তিন প্রান্তিকে মুনাফা কমার কারণ হিসাবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, এই সময়ে তাদের ক্যাপিটাল গেইন, ঋণের বিপরীতে সুদ আয় ও ডিভিডেন্ড আয় উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। এজন্য কোম্পানির নিট মুনাফাও কমেছে।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স

সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২ অর্থবছরে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস-এর মোট আয় হয়েছিল ১৪৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ আয়ের থেকে কোম্পানিটির ব্যয় ৩১.২০ শতাংশ বেশি হয়েছিল। অর্থ বছরটিতে কোম্পানিটির নিট লোকসান আগের বছরের তুলনায় ১৩.১০ শতাংশ কমে হয়েছিল ১৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির মোট আয় হয়েছে ৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির আয়ের থেকে ব্যয় ১৪ শতাংশ বেশি হয়েছিল। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ সময়ে কোম্পানিটির কর পরবর্তী নিট লোকসান ৪.৮০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৬১ কোটি ১০ লাখ টাকা।

আইপিডিসি ফাইন্যান্স

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের মোট আয় হয়েছে ৩৭৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৫৮ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কোম্পানিটির নিট মুনাফা ৭৮.৪১ শতাংশ কমে হয়েছে ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। যেখানে ২০২২ অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ৭৫৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছিল ৪৫.৮০ শতাংশ। অর্থ বছরটিতে কোম্পানিটির নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় ২.২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছিল ৯০ কোটি ১০ লাখ টাকা।

কোম্পানিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে তাদের আমানতের বিপরীতে সুদ ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি কর্মীদের বেতন ও ভাতা বাবদ ব্যয় বেশি হয়েছে। এ ছাড়া আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটিকে ঋণ ও বিনিয়োগের বিপরীতে বেশি হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এসব কারণে এ সময়ে কোম্পানিটির মুনাফা কমেছে।

ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের মোট আয় হয়েছে ৮২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৩২.৭০ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কোম্পানিটির নিট মুনাফা ২০.৭৮ শতাংশ কমে হয়েছে ১২ কোটি ২০ লাখ টাকা। যেখানে ২০২২ অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ১৫৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছিল ৩৪.৭০ শতাংশ। অর্থ বছরটিতে কোম্পানিটির নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় ০.৭৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছিল ২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

এই বিষয়ে ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের কোম্পানি সচিব সারওয়ার কামাল দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ অনুসারে ব্যয় সাশ্রয়ের পথ অনুসরণ করছি। আলোচ্য সময়ে আমাদের ব্যয় কিছুটা কমেছেও। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে আসলে ব্যয় কমানোটা অনেকটা কষ্টকর। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনেই আমাদের ঋণের ওপর সুদহার কমাতে হয়েছে। পাশাপাশি আমানতের বিবরণীতে গ্রাহক ধরে রাখার স্বার্থেই কিছুটা বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। এসব কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে আমাদের মুনাফা কমেছে।

ইউনাইটেড ফাইন্যান্স

সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২ অর্থবছরে ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের মোট আয় হয়েছিল ২৩১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৭১ শতাংশ। এই অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় কোম্পানির নিট মুনাফা ৩৫.৫৯ শতাংশ কমে হয়েছিল ১৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির মোট আয় হয়েছিল ১১৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৮০.৩০ শতাংশ। এ সময় কোম্পানির নিট মুনাফা ৬৭.৭৪ শতাংশ কমে হয়েছে ১ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে মুনাফা কমার প্রধান কারণ হিসাবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, এ সময় ব্যয় বৃদ্ধির চাপে তাদের পরিচালন আয় উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। এতে তাদের নিট মুনাফায় ভাটা পড়েছে।

ফার্স্ট ফাইন্যান্স

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ফার্স্ট ফাইন্যান্সের মোট আয় হয়েছে ১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই সময়ে কোম্পানিটির আয়ের থেকে ব্যয় ১৭.২০ শতাংশ বেশি হয়েছিল। তবে আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কিছুটা বাড়ায় এই সময়ে কোম্পানিটির কর পরবর্তী নিট লোকসান ৩৬.৪৮ শতাংশ কমে হয়েছে ৩১ কোটি টাকা। যেখানে ২০২২ অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর আয়ের থেকে ব্যয় ৩১.২০ শতাংশ বেশি হয়েছিল। অর্থ বছরটিতে কোম্পানিটির নিট লোকসান আগের বছরের তুলনায় ২১.৪১ শতাংশ কমে হয়েছিল ১৭২ কোটি ১০ লাখ টাকা।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, আলোচ্য সময়ে অধিকাংশ কোম্পানির খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর খেলাপি ঋণ বাড়লে এমনিতেই স্প্রেড হার কমে যায়। পাশাপাশি এই সময়ে কোম্পানিগুলোর তহবিল ব্যয়ও কিছুটা বেড়েছে।

তিনি বলেন, পাশাপাশি ডলারের বিপরীতের টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণেও এ সময়ে আমানতের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গ্রাহকদের উচ্চহারে সুদ দিয়ে রাখতে হচ্ছে। এসব কারণেও মূলত চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে অধিকাংশ কোম্পানির মুনাফা কমেছে।

শেয়ারনিউজ, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩