ঢাকা, সোমবার, ১১ আগস্ট ২০২৫
Sharenews24

শেয়ারবাজারে ব্লকচেইন— স্বচ্ছতা ফেরানোর নতুন দিগন্ত

২০২৫ আগস্ট ১১ ১৫:৩২:৪২
শেয়ারবাজারে ব্লকচেইন— স্বচ্ছতা ফেরানোর নতুন দিগন্ত

সাইফুল ইসলাম পিপন: বাংলাদেশের শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যায় জর্জরিত— বাজার কারসাজি, তথ্য গোপন, সেটেলমেন্টে দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গভীর আস্থাহীনতা। এমন এক সময় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, যখন প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুনভাবে গড়ে তুলছে। এর মধ্যে ব্লকচেইন প্রযুক্তি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা শেয়ারবাজারের লেনদেনকে স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং দ্রুত করার অসাধারণ সম্ভাবনা তৈরি করেছে। অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ ইতিমধ্যেই তাদের শেয়ারবাজারে ব্লকচেইন ব্যবহার শুরু করেছে এবং বাস্তব সুফল পাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো— বাংলাদেশ কি এই প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে আস্থা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রস্তুত?

ব্লকচেইন প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা ও বৈশিষ্ট্য

ব্লকচেইন মূলত একটি বিকেন্দ্রীভূত ডিজিটাল লেজার, যেখানে প্রতিটি লেনদেন বা তথ্য ব্লকে রেকর্ড হয় এবং পূর্ববর্তী ব্লকের সাথে ক্রিপ্টোগ্রাফিকভাবে সংযুক্ত থাকে। একবার কোনো তথ্য সংযুক্ত হলে তা পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব, ফলে প্রতিটি রেকর্ড স্থায়ী ও যাচাইযোগ্য হয়ে থাকে। শেয়ারবাজারের জন্য এটি একটি বিপ্লবাত্মক প্রযুক্তি কারণ এর মাধ্যমে প্রতিটি শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের ইতিহাস এমনভাবে সংরক্ষিত থাকবে যা গোপন কারসাজি বা তথ্য বিকৃতির সুযোগ কমিয়ে আনবে।

উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের অভিজ্ঞতা

অস্ট্রেলিয়ার Australian Securities Exchange (ASX) ২০২৩ সালে তাদের CHESS সেটেলমেন্ট সিস্টেমে ব্লকচেইন সংযোজন করেছে। ফলে সেটেলমেন্ট সময় ২-৩ দিন থেকে কমে এসেছে প্রায় তাৎক্ষণিক পর্যায়ে এবং বাজারের লিকুইডিটি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সুইজারল্যান্ডের SIX Digital Exchange সম্পূর্ণ ব্লকচেইন-ভিত্তিক লেনদেন ব্যবস্থা চালু করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করেছে।

শুধু উন্নত দেশেই নয়, এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- ভারত তাদের কয়েকটি স্টক এক্সচেঞ্জে ব্লকচেইন-ভিত্তিক ট্রেড রিপোর্টিং এবং সেটেলমেন্টে পাইলট প্রকল্প চালু করেছে, যা কারসাজি সনাক্তকরণে সহায়ক প্রমাণিত হয়েছে। ফিলিপাইন স্টক এক্সচেঞ্জও ব্লকচেইন ব্যবহারের মাধ্যমে শেয়ার ইস্যু ও রেকর্ড রাখার স্বচ্ছতা বাড়িয়েছে। এমনকি ভিয়েতনাম সরকার ডিজিটাল বন্ড লেনদেনে ব্লকচেইন প্রয়োগ করে সেটেলমেন্ট সময় ও প্রশাসনিক ব্যয় কমাতে সক্ষম হয়েছে। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে, প্রযুক্তিটি কেবল ধনী দেশেই নয় বরং উন্নয়নশীল দেশেও সফলভাবে কার্যকর করা সম্ভব।

বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য সুবিধা

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ব্লকচেইন প্রযুক্তি সংযোজন হলে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসবে লেনদেনের স্বচ্ছতায়। প্রতিটি শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় স্থায়ীভাবে রেকর্ড হয়ে যাবে, যা জনসম্মুখে যাচাইযোগ্য হবে এবং পরিবর্তনযোগ্য নয়। এর ফলে বিনিয়োগ সন্ত্রাসীদের কারসাজির সুযোগ নাটকীয়ভাবে কমে আসবে। সেটেলমেন্ট প্রক্রিয়া বর্তমানের T+2 বা T+3 থেকে কমে কয়েক সেকেন্ডে সম্পন্ন হবে, যা বাজারের লিকুইডিটি বাড়াবে এবং বিনিয়োগকারীদের পুঁজি দ্রুত ঘুরে আসতে সহায়তা করবে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিনিয়োগকারীরা নিজেরাই তাদের লেনদেনের ইতিহাস সরাসরি যাচাই করতে পারবে, ফলে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতি নির্ভরশীলতা কমবে এবং আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা রিয়েল-টাইমে বাজার পর্যবেক্ষণ করতে পারবে, যা অনিয়ম দ্রুত সনাক্ত ও প্রতিরোধে সহায়তা করবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছেও বাজারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, কারণ তারা উন্নত নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা পাবে।

বাংলাদেশেসম্ভাব্য সীমাবদ্ধতা

তবে ব্লকচেইন প্রযুক্তি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ থাকবে। প্রথমত, ব্লকচেইন চালু করতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সার্ভার, উন্নত সাইবার সিকিউরিটি এবং প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন হবে, যা এককালীন বড় বিনিয়োগ দাবি করবে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান সিকিউরিটিজ আইন, ডিপোজিটরি অ্যাক্ট ও এক্সচেঞ্জ প্রবিধানে সংশোধন আনতে হবে, যা প্রশাসনিকভাবে সময়সাপেক্ষ। তৃতীয়ত, বিনিয়োগ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই প্রযুক্তির বিরোধিতা করবে, কারণ এটি কার্যকর হলে তাদের গোপন ম্যানিপুলেশন আর সম্ভব হবে না।

এছাড়া, বাজারের সকল অংশগ্রহণকারীর— ব্রোকার, ডিপোজিটরি, নিয়ন্ত্রক এবং বিনিয়োগকারী— প্রশিক্ষণ ও অভিযোজন জরুরি হবে। নইলে নতুন প্রযুক্তি চালুর পরও পুরনো অভ্যাস ও সীমাবদ্ধতা বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে।

ব্লকচেইন ও AI ইন্টিগ্রেশন

ব্লকচেইন প্রতিটি লেনদেনকে স্থায়ী ও যাচাইযোগ্যভাবে রেকর্ড করবে, আর AI (Artificial Intelligence) সেই ডেটাকে রিয়েল-টাইমে বিশ্লেষণ করবে। উদাহরণস্বরূপ- যদি কোনো নির্দিষ্ট স্টকে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়, AI সাথে সাথে সেটি চিহ্নিত করবে এবং সতর্কবার্তা পাঠাবে। এর ফলে দীর্ঘ তদন্ত বা ম্যানুয়াল বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে না— কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কারসাজির সম্ভাব্য কার্যক্রম শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

AI এর ডেটা মডেল বাজারের স্বাভাবিক লেনদেন প্যাটার্ন শিখে নেবে, ফলে অস্বাভাবিক লেনদেন সহজেই চোখে পড়বে। এই সমন্বয় শুধু কারসাজি প্রতিরোধেই নয়, বরং বাজার বিশ্লেষণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য সুপারিশঃ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) এবং এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষের উচিত প্রথম ধাপে একটি পাইলট প্রকল্প চালু করা, যেখানে সীমিত সংখ্যক শেয়ারের লেনদেন ব্লকচেইন প্ল্যাটফর্মে পরিচালিত হবে। এর সাথে AI ইন্টিগ্রেশন যুক্ত করে কারসাজি সনাক্তকরণের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা যেতে পারে।

পাশাপাশি, আইনগত সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে, যাতে প্রযুক্তি বাস্তবায়নে কোনো আইনি জটিলতা না থাকে। বিনিয়োগকারী, ব্রোকার এবং নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে তারা প্রযুক্তির সুবিধা বুঝে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে। বিদেশি বাজারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ধাপে ধাপে পুরো বাজারে ব্লকচেইন সংযোজন করলে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং বিনিয়োগকারীর আস্থা— সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

সর্বপরি— ব্লকচেইন প্রযুক্তি কেবল একটি প্রযুক্তিগত আপগ্রেড নয়, বরং বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে আস্থা পুনর্গঠনের জন্য একটি মৌলিক সংস্কার। উন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের সফল উদাহরণ আমাদের দেখিয়েছে— এই প্রযুক্তি সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে বাজার হবে নিরাপদ, স্বচ্ছ ও বিনিয়োগবান্ধব। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের— আমরা কি এই প্রযুক্তি গ্রহণ করে ভবিষ্যতের দিকে এগোব, নাকি অতীতের অন্ধকারেই আটকে থাকব?

লেখক: শেয়ারবাজার বিশ্লেষক

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে